ইতিহাসের পাতায় অনেক অদ্ভুত ঘটনার উল্লেখ আছে, কিন্তু ১৫১৮ সালের “ড্যান্সিং প্লেগ” বা নাচের মহামারী ছিল সবচেয়ে রহস্যময় এক অধ্যায়। আজও বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে খুঁজে ফিরছে এর উত্তর—
রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তি কেন নাচে?
🔥 শুরুটা এক নারীর হাত ধরে
১৫১৮ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি, ফ্রান্সের স্ট্রাসবুর্গ শহরে এক সাধারণ নারী ফ্রাউ ট্রফেয়া (Frau Troffea) রাস্তায় বেরিয়ে এলেন।
কোনো উৎসব নেই, কোনো সংগীত নেই, তবুও তিনি নাচতে শুরু করলেন—উন্মত্তভাবে।
প্রথমে সবাই ভেবেছিল, হয়তো কোনো মানসিক সমস্যা।
কিন্তু দিন গড়াতেই দেখা গেল, আরও ৩০-৪০ জন মানুষ যেন তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচছে—কেউ থামতে পারছে না!
😱 এক সপ্তাহে শতাধিক, দুই সপ্তাহে চারশো মানুষ!
স্ট্রাসবুর্গের রাস্তায় শুরু হয় এক ভয়ংকর দৃশ্য—
মানুষ নাচছে, রক্ত ঝরছে, পা ভেঙে যাচ্ছে, ঘামে ভিজে যাচ্ছে পোশাক, কিন্তু শরীর থামছে না।
অনেকে ক্লান্তিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে, কেউ হৃদরোগ বা স্ট্রোকে মারা যাচ্ছে।
ঐতিহাসিক নথি অনুযায়ী, কমপক্ষে ৩৪ জন মানুষ “নাচতে নাচতে” মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
🎻 অদ্ভুত চিকিৎসা — “আরও নাচো!”
চিকিৎসকরা ভেবেছিলেন, হয়তো শরীর থেকে “গরম রক্ত” বের হলে আরোগ্য আসবে।
তাই শহরের কর্তৃপক্ষ তৈরি করল “নাচের স্টেজ”, বাজানো হলো সঙ্গীত, আনল বাদ্যযন্ত্রীদের দল—
ভাবল, এতে নাচের মানুষরা হয়তো ক্লান্ত হয়ে থেমে যাবে।
কিন্তু ফল হলো বিপরীত!
আরও মানুষ আক্রান্ত হলো।
পুরো শহর এক সময় যেন “সংক্রামক নৃত্যের” কবলে পড়ে গেল।
🧠 বিজ্ঞান কী বলে?
আজও প্রশ্ন জাগে — রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তি কেন নাচে?
ইতিহাসবিদ ও চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা কয়েকটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দেন:
-
Mass Psychogenic Illness (সম্মিলিত মানসিক বিকার):
দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র্য, ধর্মীয় ভয় — এসব চাপ মানুষের মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে দিয়েছিল। এক জনের উন্মাদনা সমাজে ছড়িয়ে পড়ে “মানসিক সংক্রমণ” হিসেবে। -
Ergot Poisoning (এরগট বিষক্রিয়া):
গমে জন্মানো এক প্রকার ছত্রাক, যা LSD-এর মতো হ্যালুসিনেশন সৃষ্টি করে। ফলে মানুষ বাস্তবতা হারিয়ে ফেলে, শরীর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। -
Religious Trance বা ধর্মীয় উন্মাদনা:
মধ্যযুগে অনেকেই বিশ্বাস করত এটি ঈশ্বরের শাস্তি। তাই নাচের মাধ্যমে পাপ মোচন করা যায়—এই বিশ্বাস থেকে অনেকেই নিজে থেকেই নাচতে শুরু করেছিল। -
Sociogenic Effect (সামাজিক প্রভাব):
এক জনকে দেখে অন্য জনের মস্তিষ্কও সেই আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। একে বলা হয় “Mirror Neuron Effect” — মানুষ মানুষকে নকল করতে শুরু করে, এমনকি অবচেতনেও।
💀 নাচের শেষ সুর
১৫২০ সালের দিকে এই মহামারী ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়।
শহর আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করে।
কিন্তু স্ট্রাসবুর্গ রেখে যায় এক প্রশ্নচিহ্ন —
মানুষ কিভাবে এমন এক নাচে মেতে উঠেছিল, যা মৃত্যুর পথে নিয়ে গিয়েছিল?
🧩 রহস্যের গভীরে এক শিক্ষা
“ড্যান্সিং প্লেগ” আমাদের মনে করিয়ে দেয়,
মানুষের মন ও শরীর একে অপরের সাথে গভীরভাবে যুক্ত।
যখন সমাজ, ধর্ম, ভয় এবং মানসিক চাপ একসাথে মিশে যায়, তখন মানুষের আচরণও হয়ে যেতে পারে অপ্রতিরোধ্য, এমনকি নৃত্য হয়ে উঠতে পারে মৃত্যুর দরজা।
আজও “রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তি কেন নাচে?” — এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাওয়া যায়নি।
কিন্তু এই ইতিহাস আমাদের শেখায়,
মানুষের মস্তিষ্কের জটিলতা, সমাজের প্রভাব এবং বিশ্বাসের শক্তি—
সব মিলেই মানবজাতিকে এমন অদ্ভুত পরিস্থিতিতে ফেলে দিতে পারে,
যেখানে রোগ মানে নাচ, আর নাচ মানে মৃত্যু।
