মানুষ আর আগের মতো বই পড়ে না কেন?—বাংলাদেশের বাস্তবতা ও কারণসমূহ


মানুষ আর আগের মতো বই পড়ে না কেন?—বাংলাদেশের বাস্তবতা ও কারণসমূহ
বইকে পাশে রেখে মোবাইল ব্যাবহার এখন
 নিতৃ দিনের কাজ।

একসময় সন্ধ্যা নামলেই গ্রামে-শহরে বই হাতে দেখা যেত অসংখ্য মানুষকে—কেউ কবিতা পড়ছে, কেউ গল্প, কেউবা উপন্যাসে হারিয়ে যাচ্ছে। সময় ছিল ধীর, মানুষের ধৈর্য ছিল দীর্ঘ, আর বই ছিল বিনোদন আর জ্ঞানের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে সেই চিত্র অনেকটাই বদলে গেছে। প্রশ্ন জাগে—মানুষ আর আগের মতো বই পড়ে না কেন?
এই ব্লগে আমরা বিশদভাবে আলোচনা করব এই পরিবর্তনের আসল কারণগুলো, আধুনিক জীবনের প্রভাব, প্রযুক্তির ভূমিকা, এবং বই পড়ার অভ্যাস কীভাবে বাঁচানো যেতে পারে।

১. স্মার্টফোনের আসক্তি: সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী

বাংলাদেশে স্মার্টফোন ব্যবহার বেড়েছে ভয়ংকর গতিতে। বর্তমানে ৩ বছর বয়সী শিশুর হাতেও স্মার্টফোন দেখা যায়।
ফলাফল—

  • শর্টফর্ম ভিডিওর আসক্তি, যেমন TikTok, Facebook Reels, YouTube Shorts ইত্যাদি। 
  • ডোপামিনের অতিরিক্ত মাত্রা, যা চটজলদি বিনোদন দেয়।
  • দীর্ঘ টেক্সট পড়ার ধৈর্য নষ্ট হয়ে যাওয়া।

একটি বই পড়তে সময় লাগে, মনোযোগ লাগে, কিন্তু রিল বা শর্ট ভিডিওতে ১৫ সেকেন্ডেই বিনোদন পাওয়া যায়।
অতএব, বই তার জায়গা হারাচ্ছে দ্রুতগতির ডিজিটাল কনটেন্টের কাছে।

২. ব্যস্ত জীবনযাপন — সময় নেই, মনোযোগ নেই

আজকের বাংলাদেশে জীবনের গতি আগের চেয়ে অনেক দ্রুত।

  • ছাত্রছাত্রী ব্যস্ত টিউশন–কোচিংয়ে
  • চাকরিজীবীরা ব্যস্ত ৯টা–৬টার চাপ নিয়ে
  • ব্যবসায়ীরা ব্যস্ত প্রতিযোগিতায়
  • গৃহিণীরা ব্যস্ত সংসারের কাজে

সব মিলিয়ে মানুষ সময় পেলেও মানসিকভাবে ক্লান্ত, ফলে বই হাতে নিলেও মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না।

অনেকে বলে,
“বই পড়তে চাই, কিন্তু সময় পাই না।”
কিন্তু বাস্তবে সময়ের অভাব নয়—মনের স্থিরতার অভাব

৩. বইয়ের দাম বেড়ে যাওয়া এবং অর্থনৈতিক চাপ

বাংলাদেশে বই কেনা এখন অনেকের জন্য বিলাসিতা।

  • কাগজের দাম বেড়েছে
  • মুদ্রণ খরচ বেড়েছে
  • প্রকাশনার খরচ বেড়েছে

ফলে সাধারণ বইয়ের মূল্যও ২০০–৬০০ টাকার নিচে পাওয়া কঠিন।
একটি নিম্ন আয়ের পরিবারে বই কেনা বাস্তবে কঠিন সিদ্ধান্ত।

এদিকে বিনামূল্যের ইউটিউব, ফেসবুক, টিকটক সবসময় হাতের কাছে।
মানুষের স্বাভাবিক ঝোঁক—যেখানে খরচ কম, সেখানেই মনোযোগ বেশি।

৪. শিক্ষাব্যবস্থায় বই পড়তে উৎসাহ কম

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা মূলত—

  • পরীক্ষাভিত্তিক
  • নোট–গাইডভিত্তিক
  • রটানো মুখস্থভিত্তিক

শ্রেণিকক্ষে গল্প-উপন্যাস পড়ানোর সংস্কৃতি দুর্বল। অধিকাংশ শিক্ষক বা অভিভাবক বলেন—
“গাইড পড়, প্রশ্ন পড়, পরীক্ষায় ভালো কর।”
ফলে বই পড়া আনন্দ হিসেবে নয়, বোঝা হিসেবে ধরা হয়।
এই সিস্টেম মানুষকে শুধু নম্বরমুখী করে, জ্ঞানমুখী করে না।

৫. লাইব্রেরি সংস্কৃতি প্রায় হারিয়ে গেছে

একসময়—

  • গ্রামে গ্রামে পাঠাগার ছিল
  • পাড়া-মহল্লায় ক্লাব লাইব্রেরি ছিল
  • স্কুল-কলেজ লাইব্রেরি ছিল সক্রিয়

আজ তার অধিকাংশই বন্ধ অথবা অব্যবহৃত।
ডিজিটাল যুগে লাইব্রেরি সংস্কৃতি টিকে থাকেনি, ফলে বইয়ের সাথে মানুষের সংযোগ কমে গেছে।

৬. পরিবারে বই পড়ার পরিবেশ নেই

আগে বাবা–মা বই পড়তেন, সন্তানরা দেখে অভ্যাস করত।
এখন?

  • বাবা স্মার্টফোনে ফেসবুক চালান
  • মা দেখছেন ড্রামা
  • ভাই খেলছে PUBG
  • আর বোন স্ক্রল করছে TikTok

ফলে শিশুরা বইয়ের কোনো উদাহরণ দেখে না।
পরিবার যখন ডিজিটাল বিনোদনে ডুবে থাকে, তখন বই স্বাভাবিকভাবেই দূরে সরে যায়।

৭. ইন্টারনেটের তথ্যের অতিরিক্ততা

আগে মানুষ এক তথ্যের জন্য পুরো বই পড়ত।
এখন?
২ সেকেন্ডের গুগল সার্চে সেই তথ্য পাওয়া যায়।
ফলে মানুষের মনে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে—
“বই না পড়লেও সব জানা যায়।”
কিন্তু বাস্তবে তথ্য আর জ্ঞান এক নয়।
বই জ্ঞান দেয়, অভিজ্ঞতা দেয়, চিন্তার গভীরতা দেয়—যা ইন্টারনেটের সংক্ষিপ্ত কনটেন্ট দিতে পারে না।

৮. বিনোদনের বিকল্প বেড়ে যাওয়া

আগে বিনোদন বলতে ছিল—

  • বই
  • গল্প
  • রেডিও
  • খেলাধুলা 
  • পারিবারিক গল্প ইত্যাদি 

এখন বিনোদনের দুনিয়া বিশাল—

  • ওয়েব সিরিজ
  • ফেসবুক
  • টিকটক
  • মোবাইল গেম
  • ইউটিউব ব্লগ
  • নিউজ পোর্টাল
  • লাইভ স্ট্রিমিং

বই এই প্রতিযোগিতায় খুব পিছিয়ে পড়ে গেছে।

৯. মানসম্মত লেখক ও বইয়ের সংকট

আজকাল প্রচুর বই ছাপা হয়, কিন্তু মানসম্মত বই খুব কম।
অনেকে বই লেখেন শুধুই বইমেলায় বিক্রি হওয়ার জন্য—

  • গল্প দুর্বল
  • ভাষা দুর্বল
  • রিসার্চ নেই
  • বিষয়বস্তু নেই

মানহীন বই পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না।
একবার বাজে বই পড়লে মানুষ দ্বিতীয়বার বই হাতে নিতে ভয় পায়।

বাংলাদেশে বই পড়ার অভ্যাস কমে যাওয়ার সারসংক্ষেপ

প্রধান কারণগুলো হলো—

  • স্মার্টফোন ও শর্টফর্ম ভিডিও
  • মনোযোগ কমে যাওয়া
  • ব্যস্ত জীবন
  • বইয়ের দাম বৃদ্ধি
  • শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা
  • লাইব্রেরি সংস্কৃতির পতন
  • পরিবারে বই পড়ার পরিবেশের অভাব
  • বিকল্প বিনোদনের বিস্ফোরণ
  • মানসম্মত বইয়ের সংকট ইত্যাদি 

বই পড়ার অভ্যাস পুনরুদ্ধার করা কীভাবে সম্ভব?

বাংলাদেশে আবার মানুষকে বই পড়াতে চাইলে—

 ১. পরিবারে "বই পড়ার সময়" চালু করা

 ২. স্কুলে "রিডিং আওয়ার" বাধ্যতামূলক করা

 ৩. সাশ্রয়ী মূল্যের বই প্রকাশ করা

 ৪. পাবলিক লাইব্রেরি পুনরুজ্জীবন করা

 ৫. বই পড়াকে সামাজিক ট্রেন্ড করা

 ৬. লেখকদের মান উন্নয়ন ও রিসার্চ বৃদ্ধি

 ৭. শিশুদের গল্পের বই উপহার দেওয়া

 ৮. মাসে অন্তত ১টি বই পড়ার চ্যালেঞ্জ চালু করা

কারণ বই শুধু জ্ঞানই দেয় না—মানুষকে মানুষ বানায়।

শেষ কথা 

মানুষ আর আগের মতো বই পড়ে না—এটি সত্যি, কিন্তু পরিবর্তন করা অসম্ভব নয়।
বাংলাদেশে বই পড়ার অভ্যাস কমে গেলেও এখনও লাখো পাঠক বই ভালোবাসে, বইমেলায় ভিড় করে, নতুন বইয়ের অপেক্ষায় থাকে।
আমাদের প্রয়োজন শুধু উৎসাহ, সঠিক পরিবেশ, এবং সচেতনতা।

যখন সমাজ বইকে আবার গুরুত্ব দেবে, তখনই মানুষ আবার বইয়ের কাছে ফিরে আসবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন