আমাদের শরীর মাঝে মাঝে হঠাৎ এমন হয় কেন?

 



  গায়ে কাঁটা দেওয়া বা Goosebumps এর বৈজ্ঞানিক কারণ

মানুষের শরীর আসলে অসাধারণ এক জীবন্ত যন্ত্র। বাইরে সামান্য উত্তেজনা, ভয়, ঠান্ডা বা অনুভূতির পরিবর্তন—মুহূর্তেই শরীরে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তার মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হলো গায়ে কাঁটা দেওয়া বা Goosebumps
বাংলায় অনেকে একে বলে— রোম খাড়া হয়ে যাওয়া, গা শিউরে ওঠা, গা কাঁটা দেওয়া

উপরে থাকা ছবিতে আপনি দেখতে পাচ্ছেন হাতের চামড়ায় ছোট ছোট উঁচু দাগ। এটাকেই আমরা Goosebumps বলি। প্রশ্ন হলো—
আমাদের শরীরে হঠাৎ এভাবে কেন হয়? এর পেছনে আসল বৈজ্ঞানিক কারণ কী? শুধু ঠান্ডায় হয়, নাকি মনেও এর ভূমিকা আছে?

আজকের এই ব্লগে আমরা খুব সহজ ভাষায় সব জানতে পারব।

গায়ে কাঁটা দেওয়া কি?

Goosebumps হলো আমাদের ত্বকের নিচে থাকা ক্ষুদ্র একটি পেশীর প্রতিক্রিয়া—যার নাম Arrector Pili Muscle
এই পেশি যখন সংকুচিত হয়, তখন প্রতিটি রোমকূপ একটু ওপরে উঠে যায় এবং চামড়ায় ছোট ছোট দানা বা বাম্প দেখা যায়।

বিজ্ঞানীদের ভাষায় একে বলা হয়:

Piloerection বা Pilomotor Reflex

এই প্রতিক্রিয়া আমাদের শরীরের Autonomic Nervous System দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। মানে, এটা আমাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে না—শরীর নিজে থেকেই করে।

কেন Goosebumps হয়? – ৫টি প্রধান কারণ

১. ঠান্ডা লাগলে শরীরের প্রাকৃতিক সুরক্ষা ব্যবস্থা

ঠান্ডা অনুভব করলে আমাদের শরীর নিজের তাপমাত্রা ধরে রাখতে চায়। তখন রোমকূপের নিচের পেশিগুলো সংকুচিত হয় এবং ছোট বাম্প তৈরি হয়।
মানুষের লোম কম হওয়ায় এই প্রতিক্রিয়া আমাদের কাজে লাগে না, তবে অন্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে এটা খুব কার্যকর।

যেমন—

  • বিড়াল ভয় পেলে শরীর ফুলিয়ে নেয়
  • পাখিরা ঠান্ডায় পালক ফুলিয়ে নেয়

মানুষের ক্ষেত্রে এটি একটি evolutionary leftover, অর্থাৎ পূর্বপুরুষদের সময় থেকে আসা একটি বৈশিষ্ট্য।

২. ভয় বা বিপদের আশঙ্কা

আপনি হঠাৎ ভয় পেলে, রাস্তায় কুকুর তেড়ে আসলে, বা কোনো অস্বাভাবিক শব্দ শুনলে আপনার গায়ে কাঁটা দিতে পারে।
কারণ তখন শরীর Fight or Flight Response চালু করে।

এখন কী হয়?

  • অ্যাড্রেনালিন হরমোন বৃদ্ধি পায়
  • হৃদস্পন্দন বাড়ে
  • পেশি সক্রিয় হয়
  • এবং রোমকূপ সংকুচিত হয়ে দাঁড়িয়ে যায়

এটা শরীরের সতর্ক সংকেত।

৩. অতিরিক্ত উত্তেজনা বা গভীর আবেগ

আমরা মুভিতে কোনো আবেগময় দৃশ্য দেখলে, প্রিয় গান শুনলে, হঠাৎ কারও কথা মনে পড়লে, কিংবা আবেগাপ্লুত হলে গায়ে কাঁটা দিই।
এটা সম্পূর্ণ মানসিক প্রতিক্রিয়া।

কারণ?

Dopamine ও Endorphin নামের feel-good হরমোন নিঃসরণ

যখন শরীর একধরনের "emotional shockwave" পায়, তখন Goosebumps হয়।
এটি সবচেয়ে জনপ্রিয় কারণগুলোর একটি।

৪. ব্যথা বা আঘাত পেলে

শরীরে হঠাৎ ব্যথা লাগলে বা কোনো ছোট আঘাত পেলে গা শিউরে ওঠে। এটা শরীরের সতর্ক সংকেত, যেন আপনি বুঝতে পারেন কিছু একটা সমস্যা হয়েছে।

৫. মেডিকেল কারণ বা হরমোনের পরিবর্তন

কখনো কখনো Goosebumps বারবার বা অস্বাভাবিকভাবে হলে এটি শরীরের ভেতরের কোনো সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে।

সম্ভাব্য কারণ:

  • Anxiety Disorder
  • Panic Attack
  • Fever শুরু হওয়ার সময়
  • Hypothermia
  • কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
  • হরমোনের পরিবর্তন

তবে এগুলো কমন নয়। সাধারণত আবেগ, ঠান্ডা এবং ভয়—এই তিনটাই প্রধান কারণ।

গায়ের রোম কেন খাড়া হয়?—ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা

লাখ লাখ বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষদের শরীরে অনেক বেশি লোম ছিল।
যখন ঠান্ডা পড়ত, লোম খাড়া হয়ে শরীরের ভেতরে বায়ুর একটি স্তর তৈরি করত—যা শরীর গরম রাখতে সাহায্য করত।

একইভাবে, বিপদে পড়লে লোম খাড়া হয়ে শরীর ফোলানো দেখাত, যেন শিকারী ভাবত—এটা বড় প্রাণী।

মানুষের লোম কমে গেছে, কিন্তু প্রতিক্রিয়াটি এখনো রয়ে গেছে।

গায়ে কাঁটা দেওয়া কি ক্ষতিকর?

অধিকাংশ ক্ষেত্রে না, এটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।
এটি শরীরের ন্যাচারাল রিফ্লেক্স।

তবে যদি নিচের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, তখন ডাক্তার দেখানো ভালো—

  • কোনো কারণ ছাড়াই খুব ঘন ঘন Goosebumps হওয়া
  • দীর্ঘসময় ধরে গায়ে কাঁটা থাকা
  • মাথা ঘোরা বা বুক ধড়ফড়ের সাথে হওয়া
  • ত্বকে জ্বলুনি বা ব্যথা

যদি এসব থাকে, হয়তো এটি নিউরোলজিক্যাল সমস্যা বা হরমোনজনিত সমস্যা হতে পারে।

বাংলাদেশে সাধারণ যে কারণে গায়ে কাঁটা দেয়

বাংলাদেশে নিম্নলিখিত কারণগুলো সবচেয়ে বেশি দেখা যায়—

  •  হঠাৎ ঠান্ডা বাতাস লাগা
  •  গরমে ঘেমে ঠান্ডা বাতাসে ঢোকার সময়
  •  ভয় পাওয়া (রাস্তায় কুকুর, হঠাৎ শব্দ)
  •  শরীর খারাপের শুরুতে (জ্বর উঠার আগে)
  •  আবেগপ্রবণ পরিস্থিতি
  •  বেশি উত্তেজনা বা রাগ

এগুলো পুরোপুরি স্বাভাবিক।

গায়ে কাঁটা পড়া থামানোর সহজ উপায়

যদি বারবার Goosebumps হয়, আপনি নিচের পদ্ধতিগুলো চেষ্টা করতে পারেন—

 শরীর গরম রাখুন

ঠান্ডা পরিবেশে থাকলে ত্বক সংকুচিত হয় ও Goosebumps হয়।

 গভীর শ্বাস নিন

উত্তেজনা বা ভয় হলে নার্ভ শান্ত হয়।

 পানি পান করুন

ডিহাইড্রেশন থেকেও কখনো কখনো এই প্রতিক্রিয়া হতে পারে।

 স্ট্রেস কমান

ধ্যান, প্রার্থনা, ব্যায়াম—সবাই স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে।

 প্রয়োজন হলে ডাক্তার দেখুন

বারবার কারণ ছাড়া হলে।

Goosebumps নিয়ে কিছু মজার তথ্য

  • ভয়ংকর গান শুনলে গায়ে কাঁটা দেওয়া সামাজিকভাবে "Emotional Tuning" বাড়ায়
  • ৫৫% মানুষের জীবনে অন্তত সপ্তাহে একবার Goosebumps হয়
  • কিছু মানুষের ক্ষেত্রে পরিবেশের প্রতি অতিরিক্ত সংবেদনশীলতার কারণে Goosebumps বেশি হয়
  • বয়স্ক মানুষদের Goosebumps কম হয়, কারণ ত্বক পাতলা হয়ে যায়
  • মহিলা ও পুরুষ—দুজনেরই একইভাবে Goosebumps হয়

Goosebumps কি ট্রিপোফোবিয়ার মতো?

অনেকেই গায়ে কাঁটা ওঠা দেখে ভয় পান, মনে হয় “ছিদ্র ছিদ্র কেন হয়?”
কিন্তু আসলে এটি ত্বকের স্বাভাবিক texture, কোনো রোগ নয়।
এটি ট্রিপোফোবিয়া নয়, তবে যাদের সেই ভীতি আছে, তাদের কাছে এটি ভীতিকর লাগতে পারে।

শেষ কথা 

আমাদের শরীরের Goosebumps বা গায়ে কাঁটা দেওয়া—একটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, বৈজ্ঞানিক এবং প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়া।
এটি শরীরের সুরক্ষা, আবেগ, তাপমাত্রা পরিবর্তন এবং নার্ভ সিস্টেমের একটি চমৎকার উপহার।

ঠান্ডা, ভয়, আনন্দ, মিউজিক—নানা কারণে আমাদের শরীর মুহূর্তেই প্রতিক্রিয়া জানায়।
এটিই প্রমাণ করে—মানুষ শুধু শরীর নয়, অনুভূতিও।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন