বাহ্যিক সৌন্দর্যের শিক্ষা
✍️ আবুল বাশার পিয়াস
আমার বিয়ের একটাই শর্ত—মেয়ে অবশ্যই সুন্দরী হতে হবে। এজন্য এতদিনে ১৬টা মেয়ে দেখা শেষ করেছি। কিন্তু কোনো মেয়েকেই আমার পছন্দ হয়নি। পরিবার এখন আমার ওপর ভীষণ বিরক্ত। মা আর বড় বোন প্রায় প্রতিদিনই আমাকে শুনিয়ে দেন—
“তোরে দিয়ে আর হবে না, সুন্দরী সুন্দরী করতে করতে তোকে কোনোদিন বিয়ে দেওয়া যাবে না।”
তবু আমি জেদি। বলেই দিয়েছি, কালো, মোটা, খাটো, অসুন্দরী মেয়েকে আমি বিয়ে করতে পারবো না। আমার বউ সুন্দরী হবেই।
স্বপ্নের মতো মেয়েটি
১৭তম মেয়ে যখন দেখতে গেলাম, তখনই বুঝলাম আমার খোঁজ শেষ।
তার গায়ের রঙ ইন্ডিয়ান নায়িকা তামান্না ভাটিয়ার মতো ফর্সা, উচ্চতা কৃতি শ্যাননের মতো ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি (১৭০ সেন্টিমিটার), শরীরের ফিটনেস দিশা পাটানির মতো। শুধু তাই নয়—ক্যাটরিনা কাইফের মতো খাড়া ও লম্বা নাক, ঐশ্বর্য রায়ের মতো মায়াবি চোখ, মাধুরী দীক্ষিতের মতো কোমল ও গোলাপি ঠোঁট।
মনে হচ্ছিলো—এটাই সেই মেয়ে, যাকে আমি সারাজীবন খুঁজছিলাম।
আমাকে যখন আলাদা করে তার সাথে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হলো, তখন আমি না চাইলেও বলে ফেললাম—
“আপনাকে দেখার আগে আমি ১৬টা মেয়ে দেখেছি। কাউকে ভালো লাগেনি। কিন্তু আপনাকে দেখেই মনে হলো, আমার খোঁজ এখানেই শেষ। আপনি সত্যিই খুব সুন্দর।”
মেয়ের উত্তর
সে লাজুকভাবে হেসে উত্তর দিলো—
“আমি সুন্দর কেন জানেন? কারণ আমি প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা CeraVe Foaming Cleanser দিয়ে মুখ ধুই। 236ML এর দাম প্রায় ৩ হাজার টাকা। দিনে তিনবার The Ordinary Vitamin C Serum ব্যবহার করি, যার দাম ৩২৫০ টাকা। আমি যে প্রাইমার ব্যবহার করি তার দাম ৭,৯০০ টাকা। ময়েশ্চারাইজার ১,৪৯০ টাকার।
এছাড়াও কনসিলার, টোনার, লেন্স, ফাউন্ডেশন, কাজল, ফেক ল্যাশ, লিপস্টিক, হাইলাইটার, ব্রোঞ্জার, সেটিং স্প্রে—এসব কিনতে মাসে প্রায় ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়।
তারপর প্রতি মাসে একবার করে ডার্মাটোলজিস্টের কাছে যাই, সেখানে টেস্ট-চিকিৎসা মিলিয়ে আরেক ১০ হাজার টাকা উড়ে যায়। আবার শরীর ফিট রাখার জন্য জিম করি, সেখানেও মাসে ৫ হাজার যায়।
তাহলে আমি সুন্দর না হয়ে উপায় আছে?”
এখানেই থেমে থাকেনি, বরং হেসে বললো—
“আজকাল সুন্দর না হলে আপনার মতো লোক এসে বলে যাবে—‘মেয়ে পছন্দ হয়নি।’ তাই নিজের প্রতি যত্ন নিই।”
আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো…
তার কথাগুলো শুনে আমার বুকের ভেতরটা শুকিয়ে যাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো ঘরে বাতাসই নেই। আমি বের হওয়ার পথ খুঁজছিলাম, কিন্তু মেয়েটি হঠাৎ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো—
“আমিও আপনাকে পছন্দ করেছি। মুরব্বিদের বলেন, বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করতে।”
আমি কাঁপা গলায় বললাম—
“আমি… আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না।”
মেয়ের রাগী চোখ
সে হঠাৎ রাগী চোখে তাকিয়ে উঠলো—
“কেন পারবেন না? আপনি তো সুন্দরী মেয়েই খুঁজছিলেন। এখন যখন সুন্দরী পেলেন, তখন বিয়ে করবেন না? মানুষ ভাববে আমি সুন্দর নই—এটা আমার ইগোতে লাগবে।”
আমি হাউমাউ করে কেঁদে বললাম—
“আমার মাসিক বেতন ৩০ হাজার টাকা। অথচ আপনাকে সুন্দর রাখতে মাসে কমপক্ষে ৪০-৫০ হাজার টাকা লাগবে। আপনার ভরণ-পোষণ করার মতো সামর্থ্য আমার নেই।”
সে মুহূর্তে মেয়েটা আমার শার্টের কলার ধরে চেঁচিয়ে উঠলো—
“ওরে বোকা, ভরণ-পোষণ করার যোগ্যতা নাই তো আবার সুন্দরী সুন্দরী করে আকাশ থেকে তারা নামাতে চাইস কেন? মেয়ে মানুষ কি বাজারের টমেটো নাকি, বেছে বেছে নেবি? কালো, খাটো, মোটা মেয়েরা মানুষ না? তুই আবার কোথাকার কোন হিরো যে তোকে একেবারে ঐশ্বর্য রায়ের মতো বউ দিতে হবে?”
আমার শিক্ষা
আমি কাঁদতে কাঁদতে হাতজোড় করে বললাম—
“আমায় আজকের মতো মাফ করে দিন। আজকের পর আর কোনোদিন কোনো মেয়ের বাহ্যিক সৌন্দর্য নিয়ে বাড়াবাড়ি করবো না।”
কোনোমতে রুম থেকে বের হয়ে দেখি মা আর বড় বোন আমার সাথেই ওই মেয়ের বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। যতই বোঝালাম, তারা একটাই কথা বললো—
“এতদিন সুন্দরী সুন্দরী করে কান ঝালাপালা করেছিস। এখন সুন্দরী পেয়েছিস, তাকেই বিয়ে করতে হবে।”
তাই আপাতত আমি পালিয়ে যাচ্ছি। এ আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা—
বাহ্যিক সৌন্দর্যের পেছনে অন্ধভাবে দৌড়ানো মানে নিজের জীবনকে বিপদে ফেলা।
বেঁচে থাকলে নেক্সট গল্পে আবার দেখা হবে।
বাহ্যিক সৌন্দর্য নিয়ে ইতিহাসে কিছু আশ্চর্য ও বিরল ঘটনা
মানবসভ্যতার ইতিহাসে বাহ্যিক সৌন্দর্য সবসময়ই আলোচিত একটি বিষয়। কখনো সৌন্দর্যকে শক্তির উৎস ধরা হয়েছে, কখনো আবার তা হয়েছে ভয়ংকর পরিণতির কারণ। নিচে কয়েকটি বিরল ও আশ্চর্য ঘটনা তুলে ধরা হলো—
১. ট্রয় যুদ্ধ (হেলেন অব ট্রয়)
গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী হেলেন অব ট্রয়-এর সৌন্দর্যের কারণেই শুরু হয়েছিল বিখ্যাত ট্রয় যুদ্ধ। এক নারীকে কেন্দ্র করে পুরো রাজ্য ও সভ্যতার সংঘর্ষ—এটা ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা।
২. ক্লিওপেট্রার প্রভাব
মিশরের শেষ রানী ক্লিওপেট্রা শুধু তার সৌন্দর্যের জন্যই নয়, বরং সেই সৌন্দর্যকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। বলা হয়, জুলিয়াস সিজার ও মার্ক অ্যান্টনির মতো শক্তিশালী রোমান সেনানায়কদের তিনি মুগ্ধ করেছিলেন। তার সৌন্দর্য ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিয়েছিল।
৩. চীনের ইয়াং গুইফেই
চীনা ইতিহাসে ইয়াং গুইফেই-কে চার সুন্দরীর একজন বলা হয়। তার সৌন্দর্যের কারণে তাং রাজবংশের সম্রাট জুয়ানজং এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, রাষ্ট্র পরিচালনায় শৈথিল্য দেখা দেয়। অনেকে মনে করেন, তার সৌন্দর্যের প্রভাবে তাং সাম্রাজ্যের পতন দ্রুততর হয়েছিল।
৪. ফাতিমা দে মেডিসি ও সৌন্দর্যের বিজ্ঞান
ইউরোপীয় রেনেসাঁ যুগে ফাতিমা দে মেডিসি-র মতো রাজকীয় নারীরা সৌন্দর্যের জন্য বিশেষ প্রসাধন সামগ্রী ব্যবহার শুরু করেছিলেন। এ সময়েই প্রথমবার সৌন্দর্যচর্চা বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে নথিভুক্ত হয়েছিল, যা আজকের কসমেটিক্স ইন্ডাস্ট্রির ভিত্তি।
৫. "ভেনাস অব উইলেনডর্ফ" মূর্তি
প্রায় ২৫,০০০ বছর আগের প্রস্তরযুগের এই ছোট মূর্তিটি মানব ইতিহাসে সৌন্দর্য ও নারীত্বের প্রাচীন প্রতীক। ধারণা করা হয়, এটি সৌন্দর্য ও উর্বরতার প্রতীক হিসেবে পূজিত হতো।
এ ঘটনাগুলো প্রমাণ করে যে, বাহ্যিক সৌন্দর্য শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
৬. নেফারতিতির সৌন্দর্য
প্রাচীন মিশরের রানি নেফারতিতি-র সৌন্দর্যের খ্যাতি আজও টিকে আছে। তার মূর্তি বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত শিল্পকর্ম। ধারণা করা হয়, তার সৌন্দর্য ও ব্যক্তিত্ব এতটাই শক্তিশালী ছিল যে তিনি ফারাওয়ের সমান মর্যাদা পেয়েছিলেন।
৭. "দ্য ফেস দ্যাট লঞ্চড আ থাউজ্যান্ড শিপস"
শেক্সপিয়রের সাহিত্যেও বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রভাবের উদাহরণ রয়েছে। তিনি হেলেন অব ট্রয়কে বর্ণনা করেছিলেন এমন একজন নারী হিসেবে, যার সৌন্দর্যের কারণে হাজারো জাহাজ যুদ্ধে নেমেছিল। এ উক্তিটি পরবর্তীতে সৌন্দর্যের রাজনৈতিক শক্তির প্রতীক হয়ে ওঠে।
৮. মধ্যযুগের সৌন্দর্যের জন্য দ্বন্দ্বযুদ্ধ
ইউরোপের মধ্যযুগে বহুবার এমন ঘটনা ঘটেছে যেখানে কোনো রাজপুত্র বা নাইট সৌন্দর্যের দাবিদার নারীকে নিয়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধে লিপ্ত হতো। কখনো কখনো এক নারীর জন্য রাজ্য ও জমিদারি পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে যেত।
৯. আনারকলি ও সম্রাট আকবরের রাজসভা
ভারতের মুঘল আমলে আনারকলি নামের এক সুন্দরী নর্তকীর সৌন্দর্য যুবরাজ সেলিমকে (পরে সম্রাট জাহাঙ্গীর) মুগ্ধ করেছিল। তবে এই প্রেমিক সম্পর্ক সম্রাট আকবরের বিরাগভাজন হয়। বলা হয়, সৌন্দর্যের কারণে আনারকলির জীবন শেষ হয়েছিল এক নির্মম পরিণতিতে।
১০. দ্য ডায়মন্ড বিউটি কন্টেস্ট (১৮৯১)
ইতিহাসে প্রথমবার ১৮৯১ সালে লন্ডনে "ডায়মন্ড জুবিলি বিউটি কন্টেস্ট" অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যেখানে সৌন্দর্যকে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বিচার করা হয়। এটি আধুনিক মিস ইউনিভার্স বা মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতার ভিত্তি তৈরি করে।
১১. ক্লিওপেট্রার নাক প্রসঙ্গ
খ্যাতনামা দার্শনিক ব্লেজ প্যাসকাল লিখেছিলেন—
"যদি ক্লিওপেট্রার নাক কিছুটা ছোট হতো, তবে পৃথিবীর ইতিহাস অন্যরকম হতো।"
তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, সৌন্দর্য এতটাই প্রভাবশালী ছিল যে ইতিহাসের গতিপথও বদলে দিতে সক্ষম।
