"আইনস্টাইন বলেছিলেন, মহাবিশ্বে আছে তরঙ্গ"
![]() |
| গ্রাভিটেশনাল ওয়েভ |
মহাবিশ্বের রহস্য আমাদের কৌতূহলকে সবসময়ই তাড়িত করে। আমরা যখন আকাশের দিকে তাকাই, তখন শুধুমাত্র তারা, গ্রহ বা ছায়াপথই দেখি না; এর পেছনে লুকিয়ে থাকে পদার্থবিজ্ঞানের গভীরতম নিয়মগুলো। আলবার্ট আইনস্টাইন সেই নিয়মগুলো উন্মোচনের ক্ষেত্রে এক অনন্য নাম। তাঁর আপেক্ষিকতার তত্ত্ব (Theory of Relativity) শুধু মহাকাশ বোঝার ধারা পাল্টায়নি, আমাদের চিন্তাভাবনারও বিপ্লব ঘটিয়েছে। আর এই তত্ত্বের মাধ্যমেই প্রথম উঠে আসে গ্রাভিটেশনাল ওয়েভ (Gravitational Wave) বা মহাকর্ষীয় তরঙ্গের ধারণা।
তাহলে প্রশ্ন হলো—আইনস্টাইন কবে প্রথম গ্রাভিটেশনাল ওয়েভের কথা বলেন? এর পেছনের ইতিহাস কী? চলুন আমরা একসাথে সেই বৈজ্ঞানিক যাত্রায় ডুব দিই।
গ্রাভিটেশনাল ওয়েভ আসলে কী?
গ্রাভিটেশনাল ওয়েভ হলো মহাবিশ্বে সৃষ্ট অদৃশ্য তরঙ্গ, যা মহাকর্ষের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যেমনভাবে কোনো পুকুরে পাথর ফেললে ঢেউ তৈরি হয়, তেমনি মহাবিশ্বে বিশাল কোনো ঘটনা ঘটলে—যেমন দুটি ব্ল্যাক হোল একত্রিত হওয়া বা নিউট্রন তারা সংঘর্ষ—তখন স্থান-কাল (Space-Time) বেঁকে গিয়ে তরঙ্গ আকারে ছড়িয়ে পড়ে।
এই তরঙ্গ পৃথিবীতে পৌঁছাতে কোটি কোটি বছর সময় নিতে পারে। যদিও আমরা চোখে এটি দেখতে পাই না, তবে আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে এখন তা শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে।
আইনস্টাইনের যুগান্তকারী তত্ত্ব
আলবার্ট আইনস্টাইন ১৯১৫ সালে প্রকাশ করেন তাঁর বিখ্যাত সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব (General Theory of Relativity)। এই তত্ত্বে তিনি দেখান, মহাকর্ষ কেবল একটি বল নয় (যেমন নিউটন বলেছিলেন), বরং এটি হলো স্থান-কাল বা Space-Time-এর বক্রতা।
কোনো ভরযুক্ত বস্তু যেমন গ্রহ বা নক্ষত্র তার চারপাশের স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দেয়। অন্য বস্তু সেই বাঁকানো পথে চলে। এর ফলেই আমরা মহাকর্ষ অনুভব করি।
গ্রাভিটেশনাল ওয়েভের জন্ম: ১৯১৬ সাল
আইনস্টাইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব প্রকাশের পরপরই, অর্থাৎ ১৯১৬ সালে, প্রথমবার গ্রাভিটেশনাল ওয়েভের ধারণা দেন। তিনি গাণিতিকভাবে দেখান, যদি মহাবিশ্বে কোনো বড় ভরবাহী বস্তু খুব দ্রুত ত্বরণ (acceleration) লাভ করে, তাহলে সেই গতিবিধি তরঙ্গ আকারে স্থান-কাল জুড়ে ছড়িয়ে পড়বে।
এই ভবিষ্যদ্বাণী ছিল বিপ্লবী। তবে তখনকার বিজ্ঞানীরা বিষয়টি পুরোপুরি বুঝতে বা গ্রহণ করতে পারেননি। কারণ সরাসরি প্রমাণ পাওয়া ছিল অসম্ভব।
প্রথমদিকে বিভ্রান্তি ও বিতর্ক
যদিও আইনস্টাইন ১৯১৬ সালে গ্রাভিটেশনাল ওয়েভের ধারণা দেন, তিনি নিজেও কয়েক বছর পর এ নিয়ে বিভ্রান্ত হন। ১৯৩৬ সালে তিনি এক গবেষণাপত্রে এমনকি দাবি করেছিলেন যে, গ্রাভিটেশনাল ওয়েভ আসলে থাকতে নাও পারে! পরে অবশ্য তাঁর সেই বক্তব্য ভুল প্রমাণিত হয় এবং বিজ্ঞানীরা আবারও বিষয়টি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন।
এই বিভ্রান্তি দেখায় যে, এমনকি মহান বিজ্ঞানীরাও মাঝে মাঝে তাঁদের আবিষ্কার নিয়ে দ্বিধায় পড়তে পারেন। কিন্তু বিজ্ঞানের সৌন্দর্যই হলো—সঠিক প্রমাণ একসময় সবকিছু পরিষ্কার করে দেয়।
আধুনিক যুগে গ্রাভিটেশনাল ওয়েভের অনুসন্ধান
আইনস্টাইনের ভবিষ্যদ্বাণীর প্রায় একশ বছর পর অবশেষে মানুষ সরাসরি গ্রাভিটেশনাল ওয়েভ শনাক্ত করতে সক্ষম হয়।
২০১৫ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের LIGO (Laser Interferometer Gravitational-Wave Observatory) নামক একটি মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র প্রথমবারের মতো দুটি ব্ল্যাক হোলের সংঘর্ষ থেকে আসা গ্রাভিটেশনাল ওয়েভ শনাক্ত করে। এই খবরটি ২০১৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়।
এই আবিষ্কার শুধু আইনস্টাইনের ধারণাকে প্রমাণই করেনি, বরং মহাবিশ্বকে বোঝার ক্ষেত্রে নতুন দরজা খুলে দেয়।
কেন আইনস্টাইনের ভবিষ্যদ্বাণী এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল?
১. বিজ্ঞানের নতুন পথ: আইনস্টাইন দেখিয়েছিলেন মহাবিশ্ব শুধু পদার্থ বা শক্তির খেলা নয়, বরং এর মৌলিক কাঠামো—স্থান-কাল নিজেও সক্রিয়ভাবে বদলায়।
২. আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভিত্তি: গ্রাভিটেশনাল ওয়েভ এখন মহাবিশ্ব অনুসন্ধানের নতুন হাতিয়ার। এর মাধ্যমে আমরা ব্ল্যাক হোল বা নিউট্রন তারা সম্পর্কে জানার সুযোগ পাচ্ছি।
৩. মানব কৌতূহলের জয়: শত বছর আগে করা ভবিষ্যদ্বাণী শত বছর পর প্রমাণিত হওয়া বিজ্ঞানের ধৈর্য ও সত্য অনুসন্ধানের শক্তিকে প্রতিফলিত করে।
ভাবুন তো, এক শতাব্দী আগে দেওয়া একটি ধারণা আজ আমাদের বিজ্ঞানচর্চার কেন্দ্রবিন্দু। আইনস্টাইন যদি তখন এই ভবিষ্যদ্বাণী না করতেন, হয়তো আমরা আজও মহাবিশ্বের এই অদৃশ্য তরঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে যেতাম।
তারপরও সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয় হলো—আইনস্টাইন নিজেও জীবদ্দশায় তাঁর এই ভবিষ্যদ্বাণীর সরাসরি প্রমাণ দেখতে পাননি। অথচ আজ তাঁর সেই ধারণাই মহাবিশ্ব বোঝার নতুন চাবিকাঠি হয়ে উঠেছে।
গ্রাভিটেশনাল ওয়েভ নিয়ে পরবর্তী গবেষণা
আইনস্টাইনের ভবিষ্যদ্বাণীর পর বিজ্ঞানীরা ধীরে ধীরে বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে গবেষণা শুরু করেন। ১৯৫০-এর দশকে মার্কিন বিজ্ঞানী জন হুইলার (John Wheeler) এবং তাঁর সহকর্মীরা গ্রাভিটেশনাল ওয়েভ নিয়ে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেন। তাঁরা দেখান, এই তরঙ্গ কেবল কল্পনা নয়, বরং বাস্তব মহাবিশ্বে এর প্রভাব অনুভবযোগ্য।
পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো গ্রাভিটেশনাল ওয়েভের পরোক্ষ প্রমাণ পান। তাঁরা আবিষ্কার করেন একটি বাইনারি পালসার (Binary Pulsar) সিস্টেম, যেখানে দুটি নিউট্রন তারা একে অপরকে প্রদক্ষিণ করছিল। দীর্ঘ পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, তাদের কক্ষপথ ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে, যা কেবল গ্রাভিটেশনাল ওয়েভ নিঃসরণের মাধ্যমেই সম্ভব। এই আবিষ্কারের জন্য বিজ্ঞানীরা পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
প্রযুক্তিগত বিপ্লব: LIGO থেকে VIRGO
আইনস্টাইনের দেওয়া ধারণা সরাসরি প্রমাণ করা সহজ ছিল না। এজন্য প্রয়োজন হয় অতিসংবেদনশীল যন্ত্রপাতির। সেই চ্যালেঞ্জকে বাস্তবায়ন করতে ১৯৯০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে ওঠে LIGO।
দশকের পর দশক ধরে হাজারো বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। অবশেষে ২০১৫ সালে প্রথম সাফল্য আসে। দুটি ব্ল্যাক হোল সংঘর্ষের সময় তৈরি হওয়া তরঙ্গ পৃথিবীতে পৌঁছায় এবং LIGO সেটি শনাক্ত করে।
পরবর্তীতে ইউরোপের VIRGO অবজারভেটরিও এই গবেষণায় যুক্ত হয়। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে একাধিক প্রকল্প গ্রাভিটেশনাল ওয়েভ শনাক্ত করার কাজ করছে।
মহাবিশ্ব বোঝার নতুন জানালা
গ্রাভিটেশনাল ওয়েভ শনাক্ত হওয়ার পর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এটিকে "একটি নতুন জানালা" বলে অভিহিত করেছেন। কারণ, এতদিন আমরা মহাবিশ্ব সম্পর্কে জানতাম শুধু আলো (Electromagnetic Wave) পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। কিন্তু এখন মহাবিশ্বকে বোঝার জন্য আমাদের কাছে আলো ছাড়াও মহাকর্ষীয় তরঙ্গ রয়েছে।
এটি আমাদেরকে ব্ল্যাক হোল, নিউট্রন তারা, এমনকি মহাবিশ্বের প্রাচীনতম সময়ের ঘটনাও জানার সুযোগ দিচ্ছে।
আলবার্ট আইনস্টাইন ১৯১৬ সালে যে গ্রাভিটেশনাল ওয়েভের ধারণা দেন, তা প্রথমে ছিল কেবল এক বৈজ্ঞানিক ভবিষ্যদ্বাণী। তিনি নিজেও জীবদ্দশায় এর প্রমাণ পাননি। কিন্তু শত বছর পর সেই ধারণাই প্রমাণিত হয়ে মহাবিশ্ব বোঝার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
আজ আমরা জানি, মহাবিশ্বের প্রতিটি বিশাল ঘটনা শুধু আলো নয়, তরঙ্গের মাধ্যমেও তার গল্প বলে যায়। আর সেই গল্পের প্রথম পাতা লিখেছিলেন আইনস্টাইন। তাঁর সেই এক শতাব্দী পুরোনো ভবিষ্যদ্বাণী এখন আধুনিক বিজ্ঞানের সবচেয়ে উজ্জ্বল সত্যগুলোর একটি।
