বাংলা ইসলামি গান ও কাজী নজরুল ইসলাম


বাংলা ইসলামি গান ও কাজী নজরুল ইসলাম
বাংলা ইসলামি গানের সূচনা কাজী নজরুল ইসলামের হাত ধরেই আসে।
আমরা যাকে শুধু “কবি” বা “বিদ্রোহী” হিসেবে চিনি, তিনি বাস্তবে ছিলেন একজন পেশাদার মিউজিক ডিরেক্টরও!

বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাসে এক বিশেষ জায়গা দখল করে আছে ইসলামি গান। ইসলামের আবির্ভাবের পর থেকে বাংলা অঞ্চলে যে নতুন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ধারা প্রবাহিত হয়েছিল, তা শুধু রাজনীতি বা সমাজেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং মানুষের হৃদয় ও শিল্প-সংস্কৃতিতেও গভীর প্রভাব ফেলেছে। এরই ধারাবাহিকতায় জন্ম নিয়েছে বাংলা ইসলামি গানের ধারা। আর এই ধারাকে আধুনিক রূপ দিয়েছেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম

বাংলা ইসলামি গানের সূচনা

বাংলায় ইসলাম ধর্মের প্রবেশ ঘটে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বাংলা জয় (১২০৪ খ্রিস্টাব্দ) এর মাধ্যমে। এর পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে ইসলাম শুধু ধর্ম হিসেবে নয়, সংস্কৃতি হিসেবেও বাংলার সমাজে গভীরভাবে মিশে যায়।

মধ্যযুগে সুফি-দরবেশ, আলেম-ওলামারা ধর্মীয় উপদেশ ও আধ্যাত্মিক বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেন কবিতা, দোয়া, মুনাজাত ও গানের মাধ্যমে। সেই সময়ের ইসলামি গান ছিল মূলত লোকগানের ধাঁচে— সহজ-সরল ভাষা ও ভজনধর্মী সুরে ভরপুর। এগুলো মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি জাগ্রত করত এবং ইসলামি জীবনবোধে অনুপ্রাণিত করত।

বাংলা ভাষা ও সংগীতে ইসলামের অবদান

বাংলা ভাষা অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও বহুমুখী। এই ভাষার শব্দভাণ্ডার, ছন্দ ও ধ্বনি-সৌন্দর্য গানের জগতে এক বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে। ফলে সময়ের সাথে সাথে বাংলা ইসলামি গান শুধু ধর্মীয় আবেগ প্রকাশের মাধ্যম হয়ে থাকেনি, বরং হয়ে উঠেছে বাংলার সংগীত ভাণ্ডারের অন্যতম শাখা।

আজকের দিনে ইসলামি গান বাংলা সংগীতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। রমজান, ঈদ, মাওলিদ কিংবা অন্যান্য ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে এই গানগুলো ধর্মীয় আবেগকে আরও গভীর করে তোলে।

কাজী নজরুল ইসলাম ও বাংলা ইসলামি গান

বাংলা ইসলামি গানের ইতিহাসে সবচেয়ে উজ্জ্বল নাম কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁকে আমরা বিদ্রোহী কবি হিসেবে জানলেও, তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ সুরকার ও গীতিকার। তাঁর হাত ধরে বাংলা ইসলামি গান লোকগানের গণ্ডি ছাড়িয়ে পৌঁছায় আধুনিক সঙ্গীতের পর্যায়ে

নজরুলের অবদান

  • নজরুল প্রথমবারের মতো ইসলামি গানকে রাগভিত্তিক শাস্ত্রীয় সংগীতের ছন্দে রচনা করেন।
  • তাঁর গানে ইসলামি বিশ্বাস, আধ্যাত্মিকতা, মানবপ্রেম ও ভ্রাতৃত্ববোধের ছাপ স্পষ্ট।
  • তিনি শুধু ইসলাম ধর্ম নয়, মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির গৌরবকেও তুলে ধরেছেন সংগীতে।

নজরুল ইসলাম সৃষ্ট নাশিদ বা ইসলামি গান আজও সমান জনপ্রিয়। তাঁর রচিত গান যেমন মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে স্পর্শ করে, তেমনি তা বাংলা সংগীতের ইতিহাসে এক অনন্য মাত্রা যোগ করেছে।

আধুনিক বাংলা ইসলামি গান

কাজী নজরুল ইসলামের হাত ধরে ইসলামি গান একটি স্বতন্ত্র ও মর্যাদাপূর্ণ ধারায় পরিণত হলেও, আধুনিক যুগে তা আরও বহুমাত্রিক হয়েছে। আজকের দিনে ইসলামি গান পাওয়া যায়

  • কাওয়ালি ও হামদের আঙ্গিকে
  • আধুনিক সুরে রেকর্ড করা নাশিদে
  • টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত ভিডিও গানে

এসব গান শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সারা বছরের নানান উপলক্ষ্যে মানুষের আধ্যাত্মিক চাহিদা মেটায়।

বাংলা ইসলামি গান আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর মূল শিকড় নিহিত রয়েছে ইসলামের আবির্ভাবের সাথে সাথে বাংলায় গড়ে ওঠা নতুন সমাজ-সংস্কৃতিতে। আর এই ধারাকে আধুনিকতা, শিল্পগুণ ও মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর হাত ধরেই বাংলা ইসলামি গান পায় নতুন জীবন, নতুন রূপ।

আজকের দিনে ইসলামি গান শুধু ধর্মীয় আবেগ প্রকাশের মাধ্যম নয়, বরং বাংলা সংগীতের সমৃদ্ধ ভাণ্ডারের এক উজ্জ্বল অংশ, যা আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিকে আরও বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে।

বাংলা গান ও ধর্মের প্রভাব: বাংলা ইসলামি গানের ইতিকথা

বাংলা ভাষা ও গানের ইতিহাসে ধর্মীয় প্রভাব এক বিশেষ জায়গা দখল করে আছে। একদিকে যেমন চর্যাপদ বৌদ্ধ সহজিয়া ধর্মের সাধনগীতি হিসেবে ধরা হয়, অন্যদিকে শ্যামাসংগীত, ভজন, কীর্তন ইত্যাদি সনাতন ধর্মীয় গানের ধারা বাংলা সংগীতকে সমৃদ্ধ করেছে। ইসলাম ধর্মও এই ধারার বাইরে নয়। বরং মুসলিম শাসনের আগমনের পর থেকেই বাংলার গান, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ইসলামের ছাপ দেখা যায়।

বাংলা ইসলামি গানের ইতিকথা

মধ্যযুগে ইসলামি গান

বাংলা গানে মুসলিম সাহিত্যিকদের সম্পৃক্ততা শুরু হয়েছিল মধ্যযুগ থেকেই।

  • বাংলা ভাষার প্রথম মুসলিম কবি শাহ মুহম্মদ সগীর তাঁর ইউসুফ-জোলেখা কাব্যে ইসলামি কাহিনী তুলে ধরেন।
  • দৌলত উজির বাহরাম খান এর লায়লি-মজনু গ্রন্থও গ্রামীণ জনপদে পুঁথি পাঠ ও পালা আকারে গাওয়া হতো।

এসব গান ধর্মীয় কাহিনীর মাধ্যমে সমাজে ইসলামি জীবনবোধ প্রচার করত। বলা যায়, মধ্যযুগে এ ধরনের গানই ছিল বাংলার ইসলামি গানের প্রাথমিক রূপ।

আধুনিক যুগের শুরুর সংকট

কালের পরিক্রমায় বাংলা গান আধুনিকতায় সমৃদ্ধ হলেও ইসলামি গান সেইভাবে এগোতে পারেনি।

  • গ্রাম ও মহল্লায় লোকগানের ধাঁচে কিছু ইসলামি গানের প্রচলন থাকলেও শিল্পমান ছিল সীমিত।
  • সুর-লয়ের দুর্বলতা এবং আধুনিক সঙ্গীতের সাথে তাল মেলাতে না পারার কারণে শিক্ষিত শ্রোতাদের কাছে এগুলো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
  • ফলে বাঙালি মুসলমানদের ভক্তিমূলক গানের চাহিদা পূরণ করতে হতো উর্দু গজল বা কাওয়ালি শুনে।

সে সময়ে বাজারে ইসলামি গান বলতে মূলত উর্দু ভাষার গানই বোঝাতো। বাংলা ইসলামি গান তখনও সঙ্গীতশিল্পের মূলধারায় স্থান করে নিতে পারেনি।

নজরুলের আবির্ভাব: ইসলামি গানের নবজাগরণ

এমনই বন্ধ্যাত্বের যুগে এক মহীরূহের মতো আবির্ভূত হন কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি শুধু বাংলা সাহিত্য ও কবিতায় নয়, সংগীতেও নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন।

  • নজরুল প্রথমবারের মতো ইসলামি গানকে আধুনিক রাগভিত্তিক সঙ্গীতে রূপ দেন
  • তাঁর রচিত ইসলামি গানগুলোতে একদিকে ধর্মীয় আবেগ, অন্যদিকে উচ্চমানের শিল্পসৌন্দর্য মিলেমিশে গড়ে তোলে নতুন ধারা।
  • অচিরেই ইসলামি গান হয়ে ওঠে বাংলা গানের স্বতন্ত্র শাখা

নজরুলের সৃষ্ট অসংখ্য ইসলামি গান আজও রমজান, ঈদ, মাহে মাওলিদ কিংবা বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে গাওয়া হয়। তাঁর হাত ধরেই বাংলা ইসলামি গান অভিজাত শ্রেণির কাছে সমাদৃত হয়ে মূলধারার সংগীতে জায়গা করে নেয়।

বাংলা গানের ইতিহাসে ধর্মীয় প্রভাব অনস্বীকার্য। বৌদ্ধ সহজিয়া সাধন গীতি থেকে শুরু করে ভজন, শ্যামাসংগীত কিংবা ইসলামি গান— প্রতিটি ধারা বাংলা সংগীতকে করেছে আরও বৈচিত্র্যময়। তবে ইসলামি গানের প্রকৃত নবজাগরণ ঘটে বিংশ শতাব্দীতে কাজী নজরুল ইসলামের অবদানে। তাঁর অসাধারণ সৃষ্টিশীলতা ও শিল্পকুশলতায় ইসলামি গান আজ বাংলা সংগীত ভাণ্ডারের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

নজরুলের ইসলামি গান রচনার শুরু: “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে”

বাংলা ইসলামি গানের নবজাগরণের ইতিহাসে কাজী নজরুল ইসলাম এক অবিস্মরণীয় নাম। তবে তাঁর ইসলামি গান রচনার শুরুটা ছিল বেশ নাটকীয়। প্রখ্যাত লোকসংগীত শিল্পী আব্বাস উদ্দীন আহমদ এর অনুরোধেই নজরুল প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামি গান লেখা শুরু করেন।


আব্বাস উদ্দীনের প্রস্তাব ও নজরুলের সাড়া

নজরুল তখন একটি গ্রামোফোন কোম্পানির সাথে যুক্ত ছিলেন। আব্বাস উদ্দীন একদিন তাঁকে বললেন—

> “কাজীদা, পিয়ারু কাওয়াল আর কাল্লু কাওয়ালের মতো উর্দু কাওয়ালি গান বাজারে দারুণ বিক্রি হচ্ছে। আপনি যদি বাংলায় ইসলামী গান লেখেন, তাহলে মুসলমানের ঘরে ঘরে উঠবে আপনার জয়গান।”


প্রস্তাবটি নজরুলকে ভীষণ টেনেছিল, তবে সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগে তিনি কোম্পানির রিহার্সেল-ইন-চার্জ ভগবতী ভট্টাচার্যের মতামত নিতে বললেন। ভগবতী বাবু শুরুতে সরাসরি ‘না’ করে দেন। কারণ— তাঁর ধারণা ছিল, ইসলামি গানের রেকর্ড বাজারে বিক্রি হবে না।

কিন্তু আব্বাস উদ্দীনের নাছোড় অনুরোধে শেষ পর্যন্ত ভগবতী বাবু রাজি হলেন— “আচ্ছা, একবার চেষ্টা করে দেখা যাক।”


নজরুলের প্রথম ইসলামি গান

সম্মতি মিলতেই নজরুল খাতা-কলম হাতে বসে গেলেন। সেখানেই জন্ম নিলো অমর সৃষ্টি—

“ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ”

এটি শুধু একটি গান নয়, বরং বাঙালি মুসলমানের ঈদ-উৎসবের প্রতীকী সংগীত। গানটি প্রকাশের সাথে সাথেই তরুণ-বৃদ্ধ সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। পরদিনই নজরুল লিখলেন আরেকটি গান—

“ইসলামেরই ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর।”

এই দুটি গান ১৯৩১ সালের নভেম্বরে লেখা হয় এবং ১৯৩২ সালের রমজানের আগে বাজারে রেকর্ড আকারে প্রকাশিত হয়। ফলাফল ছিল বিস্ময়কর— কয়েক দিনের মধ্যেই হাজার হাজার রেকর্ড বিক্রি হয়ে যায়। যে ভগবতী বাবু প্রথমে আপত্তি করেছিলেন, তিনিই পরে আরো ইসলামি গান লেখার জন্য অনুরোধ জানালেন নজরুলকে।


নজরুলের আগের ইসলামি সৃষ্টিগুলো

অনেকে মনে করেন নজরুলের ইসলামি গানের যাত্রা এখান থেকেই শুরু, কিন্তু আসলে তা নয়।

ছোটবেলায় লেটো দলে যোগ দিয়ে তিনি ইসলামি ভাবাদর্শের গান লিখেছিলেন। যেমন—

“নামাজী, তোর নামাজ হলো রে ভুল,

মসজিদে তুই রাখলি সিজদা ছাড়ি ঈমানের মূল।”


প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে তাঁর সংগীতযাত্রার আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়েছিল “বাজলো কী রে ভোরের সানাই” গান দিয়ে।

লোকসংগীতের ধাঁচে লেখা তাঁর আরেকটি গান “সদা মন চাহে যাবো মদীনায়” কিংবদন্তি শিল্পী আবদুল আলীম ১৯২৯ সালেই কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন।

  • নজরুলের শৈশব ও ধর্মশিক্ষা
  • নজরুলের ইসলামি গানের শিকড় নিহিত তাঁর শৈশবের ধর্মীয় শিক্ষায়।
  • তাঁর পিতা ছিলেন ধর্মপ্রাণ মানুষ।

মাত্র আট বছর বয়সে পিতৃহীন হয়ে নজরুল মসজিদের মুয়াযযিন এবং মক্তবের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

ইসলাম ধর্মের শিক্ষা অল্প বয়সেই তাঁর হৃদয়ে গভীরভাবে গেঁথে যায়, যা পরবর্তী সময়ে তাঁর সংগীতে স্পষ্ট প্রতিফলিত হয়।

বাংলা ইসলামি গানের নবযাত্রা শুরু হয়েছিল “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে” গান দিয়ে। এই গান নজরুলকে শুধু ইসলামি গানের রচয়িতা হিসেবেই নয়, বরং বাংলা সংগীতের ইতিহাসে এক অমর প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। শৈশবের ধর্মশিক্ষা, জীবনবোধ ও শিল্পকুশলতার মেলবন্ধনে তিনি যে ইসলামি গান সৃষ্টি করেছিলেন, তা আজও বাঙালি মুসলমানের আবেগের অবিচ্ছেদ্য অংশ।


নজরুলের ইসলামি সংগীতের বিষয়, সুর ও ভাষাশৈলী


বাংলা গানের ভুবনে কাজী নজরুল ইসলাম এক অনন্য নাম। বিশেষ করে ইসলামি নজরুল সংগীত তাঁর সাহিত্য ও সংগীত জীবনের এক অপরিসীম সম্পদ। এই ধারার গানগুলোতে ইসলাম ধর্মের মূল শিক্ষা, আধ্যাত্মিকতা এবং মানবকল্যাণের বাণী একসাথে প্রতিফলিত হয়েছে। নজরুল শুধু গান লিখেননি, তিনি তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানের আত্মাকে জাগিয়ে তুলেছিলেন।

ইসলামি নজরুল সংগীতের বিষয় বৈচিত্র্য

নজরুল ইসলামের ইসলামি সংগীতে পাওয়া যায় বিস্ময়কর বিষয় বৈচিত্র্য। ইসলাম ধর্মের প্রতিটি মৌলিক স্তম্ভ এবং অনুষঙ্গকে তিনি গানের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন।
তিনি রচনা করেছেন—

  • তাওহীদ বিষয়ক গান – আল্লাহর একত্ববাদ ও মহান শক্তির ঘোষণা।
  • রিসালাত ও নাত – মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রশংসায় হৃদয়স্পর্শী সংগীত।
  • হামদ – আল্লাহর মহিমা বর্ণনায় রচিত গান।
  • আজান ও নামাজ বিষয়ক গান – আধ্যাত্মিক আহ্বান ও ঈমানের বার্তা।
  • রোজা, যাকাত ও হজ্ব বিষয়ক গান – ইসলামের ফরজ বিধান নিয়ে রচিত সংগীত।
  • শবে মেরাজ, শবে বরাত ও শবে কদর – ইসলামের তাৎপর্যময় রজনীগুলোর মাহাত্ম্য তুলে ধরা।
  • রমজান ও ঈদ বিষয়ক গান – যেমন কালজয়ী “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ”।
  • মহররম ও ইসলামের ইতিহাস – মুসলিম জাগরণ ও ত্যাগের কাহিনি।
  • সাম্যের শিক্ষা ও মুসলিম সমাজ সংস্কার – দারিদ্র্য বিমোচন, নারী মর্যাদা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের বার্তা।

👉 বলা যায়, কোনো ইসলামি বিষয়ই নজরুলের সৃষ্টির বাইরে রইলো না

ইসলামি নজরুল সংগীতের সুর বৈচিত্র্য

নজরুলের সঙ্গীত প্রতিভা শুধু কথায় নয়, সুরেও প্রকাশ পেয়েছে।

  • অনেক ইসলামি গান তিনি গজল আঙ্গিকে রচনা করেছেন।
  • কখনো দাদরা, কাহারবা, ঠুমরি, পল্লীগীতির ঢঙে লিখেছেন গান।
  • বিদেশি সুরও অনুকরণ করেছেন নিপুণভাবে।

উদাহরণস্বরূপ—
🔹 বিখ্যাত নাতে রাসূল “ত্রিভূবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়” গানটি তুরস্কের জনপ্রিয় গান “কাটিবিম ইশকাদার”-এর সুরে রচিত।
এই গানটির সুর বিভিন্ন দেশে অনুকরণ করা হয়েছে, এমনকি আরবি সংস্করণও বিদ্যমান ছিল। ধারণা করা হয় নজরুল সেই আরবি সুর থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।

আরেকটি গান, “শুকনো পাতার নূপুর পায়ে” একই সুরে রচিত হয়ে শ্রোতাদের হৃদয়ের গভীরে  জায়গা করে নিয়েছিল।

ইসলামি নজরুল সংগীতের ভাষাশৈলী

নজরুলের সংগীতে সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় দিক হলো ভাষার ব্যবহার

  • তিনি ছিলেন বাংলা গজলের পথিকৃৎ
  • তাঁর ইসলামি গানে বাংলা ভাষার পাশাপাশি আরবি, ফারসি ও উর্দু শব্দের চমৎকার মিশ্রণ পাওয়া যায়।
  • বহুভাষিকতা তাঁর গানে এনে দিয়েছে এক বিশেষ ইসলামি আবহ।

উদাহরণস্বরূপ, তাঁর অনেক নাতে রাসূল বা হামদে আরবি-ফারসি শব্দাবলী ব্যবহার করা হয়েছে যা শ্রোতার মনে গভীর আধ্যাত্মিকতা জাগায়।
এমনকি সংস্কৃতঘেঁষা পুরাণ ও পৌরাণিক গল্পেও তিনি আরবি-ফারসি-উর্দুর সংযোজন করে নতুনত্ব সৃষ্টি করেছেন।

👉 তবে এই সাহসী প্রয়াসের কারণে তিনি মাঝে মাঝে সমালোচিতও হয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর গানের ভাষাশৈলী বাংলা ইসলামি সংগীতকে দিয়েছে এক অনন্য উচ্চতা।

ইসলামি নজরুল সংগীতের বৈচিত্র্য, সুরের অভিনবত্ব ও ভাষার সমৃদ্ধি বাংলা গানের ভাণ্ডারকে করেছে বহুমাত্রিক। নজরুল ইসলাম শুধুমাত্র ইসলামি গান রচনা করেননি, বরং তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে ইসলামি সংগীতও হতে পারে হৃদয়গ্রাহী, কাব্যময় এবং সার্বজনীন।

আজও নজরুলের ইসলামি গান বাঙালি মুসলমানের ঈমান, আবেগ ও আনন্দের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে।

ইসলামি সংগীতের বিশ্বজনীন ধারা ও নজরুলের নাতে রাসূল রচনার সাফল্য

বাংলা ইসলামি সংগীত শুধু বাংলা ভাষার সম্পদ নয়; বরং এটি বিশ্ব-সংস্কৃতির এক অনন্য অংশ। ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে দেখা যায়, মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার দিন মদিনার শিশুরা আনন্দঘন পরিবেশে গেয়েছিলো বিখ্যাত গান “ত্বলাআল বাদরু আলাইনা…”। সেই গান থেকেই ইসলামি সংগীতের সূচনা বলে অনেকে মনে করেন। পরবর্তীতে আরবি, ফারসি, উর্দু, তুর্কি, ইংরেজি, এমনকি বাংলাসহ বিশ্বের নানা ভাষায় ইসলামি সংগীত রচিত হয়েছে। ফলে, বাংলা ইসলামি গানও বৈশ্বিক ইসলামী সংগীত ধারার অংশ হিসেবে মূল্যায়িত।

ইসলামি সংগীতের মূল ধারা: হামদ ও নাত

বিশ্বজুড়ে ইসলামি সংগীতকে মূলত দুটি ধারায় বিভক্ত করা যায়:

  1. হামদ (Hamd) → মহান আল্লাহ তাআলার প্রশস্তিমূলক সংগীত।
  2. নাত (Naat) → প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা)-এর প্রশস্তিমূলক সংগীত।

পারসি সাহিত্যিক ও কবিদের মধ্যে হাফিজ, ওমর খৈয়াম, শেখ সাদী প্রমুখ হামদ ও নাত রচনায় অসামান্য খ্যাতি অর্জন করেছেন। বাংলা সাহিত্যে এই ধারা বহন ও বিকশিত করেছেন কাজী নজরুল ইসলাম।

নাতে রাসূল রচনায় নজরুলের দক্ষতা

বাংলা ভাষায় নাতে রাসূল রচনায় নজরুলের অবদান অতুলনীয়। তিনি ইসলামি সংগীতের বিভিন্ন শাখায় কাজ করলেও নাতে রাসূল (সা) রচনায় তাঁর শিল্পীসত্ত্বা সর্বাধিক দীপ্ত হয়ে উঠেছে। ভাষা, সুর, ভাব ও আবেগ—সব মিলিয়ে নজরুলের রচিত নাতগুলো আন্তর্জাতিক মানের।

উদাহরণস্বরূপ, তাঁর বিখ্যাত নাত:

“হেরা হতে হেলে দুলে নূরানী তনু ও কে আসে হায়,
সারা দুনিয়ার হেরেমের পর্দা খুলে খুলে যায়।
সে যে আমার কামলিওয়ালা, কামলিওয়ালা।”

এই গান কেবল একটি নাত নয়; বরং ইসলামি আবেগ, সুরমাধুর্য ও নবীপ্রেমের মিশেলে নির্মিত এক অনন্য শিল্পকর্ম।

মানবীয় রূপে নবীর প্রতিচ্ছবি

নজরুলের নাতগুলোর অন্যতম বিশেষত্ব হলো—তিনি মহানবী (সা)-কে কেবল আধ্যাত্মিক রূপে নয়, বরং মানবীয় চরিত্রে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর গানে আমরা দেখি—শিশুকালে নবীজী (সা)-এর মায়ের কোলে হাসি-কান্না, কিংবা রাখাল বালকের মতো মেষ চরানো। এই মানবিক দিকের চিত্রায়ণ পাঠক-শ্রোতার মনে নবীর প্রতি এক গভীর আত্মিক টান সৃষ্টি করে।

নজরুলের গজলধর্মী নাতের বৈশিষ্ট্য

নজরুলের নাতে রাসূল গজল আঙ্গিকে রচিত হওয়ায় এতে একদিকে রয়েছে সুরের বৈচিত্র্য, অন্যদিকে রয়েছে হৃদয়ছোঁয়া আবেগ। বাংলার মাটিতে জন্ম নিয়েও তিনি তাঁর সৃষ্টিকে এমনভাবে গড়ে তুলেছেন, যা আরবি-ফারসি নাতের ঐতিহ্যের সঙ্গে সমানতালে দাঁড়াতে পারে।

সংক্ষেপে বলা যায়, নজরুলের নাতে রাসূল কেবল বাংলা সাহিত্যের সম্পদ নয়; বরং ইসলামি সংগীতের বৈশ্বিক ভাণ্ডারে এক গৌরবোজ্জ্বল সংযোজন। তাঁর গানে নবীপ্রেমের যে মানবিক ও শিল্পিত প্রকাশ দেখা যায়, তা আজও বিশ্বজুড়ে মুসলিম সমাজকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করে যাচ্ছে।

নজরুলের ইসলামি গান রচনা ও সম্পাদনা

কাজী নজরুল ইসলাম শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বাংলা ইসলামি সংগীতের ইতিহাসেও এক অনন্য মাইলফলক। তাঁর রচিত ইসলামি গানের সংখ্যা প্রায় ২৮০টির মতো। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি বলে ধারণা করা হয়। যে কয়টি গান পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতেই বলা যায়—বাংলা ইসলামি সংগীতে নজরুল আজও সবচেয়ে বড় রচয়িতা এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী সুরকার।


নজরুলের গানের সুর-সংযোজন

নজরুলের প্রায় ৮০ ভাগ ইসলামি গান তিনি নিজেই সুরারোপ করেছেন। মাত্র ৪৬টি গান অন্যদের দ্বারা সুরারোপিত। এসব সুরকারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম—কমল দাশ গুপ্ত, কে. মল্লিক, গিরীন চক্রবর্তী, পিয়ারু কাওয়াল, সুবল দাশগুপ্ত, দেলওয়ার হোসেন, আবদুল করিম খাঁ, আব্বাস উদ্দীন আহমদ প্রমুখ।

এ থেকেই বোঝা যায়, ইসলামি গান শুধু লেখাতেই নয়, সুরের মূর্ছনায়ও নজরুল ছিলেন অতুলনীয়।


বাণীতে আবেগ ও বাস্তবতার প্রতিফলন

নজরুলের ইসলামি গানের বাণীগুলোতে এমন আবেগ ও আকাঙ্ক্ষা ফুটে ওঠে, যা প্রতিটি মুসলমানের অন্তরের গভীরতম অনুভূতিকে নাড়া দেয়। যেমন তাঁর জনপ্রিয় গান—

“দূর আরবের স্বপন দেখি বাংলাদেশের কুটির হতে…”

এখানে একজন গরিব বাঙালির হজ্ব পালনের অদম্য ইচ্ছা ও অর্থাভাবে তা পূরণ করতে না পারার দুঃখকে কবি এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, যা সকলের হৃদয়ে গভীর সাড়া জাগায়।


নজরুলের ইসলামি গানের বিপুল জনপ্রিয়তা

রেকর্ড বাজারে আসার সঙ্গে সঙ্গে নজরুলের ইসলামি গান হাজার হাজার কপি বিক্রি হতো। গ্রামোফোন কোম্পানিগুলো লাভের অঙ্কে ভেসে যেত। চাহিদা এতই বেড়ে গেলো যে, শিল্পীর স্বল্পতার কারণে হিন্দু গায়ক-গায়িকাদেরকেও নাম বদলে মুসলমান সেজে ইসলামি গান গাইতে হয়েছে।


শিল্পীদের ছদ্মনাম গ্রহণের ইতিহাস

ধীরেন দাস → ‘গণি মিঞা’

ঊষারাণী → ‘রওশন আরা বেগম’

সীতা দেবী → ‘দুলি বিবি’

হরিমতী দেবী → ‘সকিনা বেগম’

চিত্ত রায় → ‘দেলওয়ার হোসেন’

গিরীণ চক্রবর্ত্তী তো কয়েকবার নাম পাল্টে ইসলামি গানের রেকর্ড করেছেন—কখনো ‘সোনা মিয়া’, কখনো ‘সুজন মাঝি’, আবার কখনো ‘গোলাম হায়দার’ নামে।


এমনকি মুসলিম শিল্পীরাও ছদ্মনামে হিন্দু ভাবাদর্শের গান গেয়েছেন। যেমন—তালাত মাহমুদ নজরুলের কয়েকটি গান গেয়েছিলেন ‘তপন কুমার’ নাম ব্যবহার করে।


কেন হিন্দু শিল্পীরাও ইসলামি গান গাইতে আগ্রহী ছিলেন?

অনেকে মনে করতে পারেন, কেবল রেকর্ড বিক্রির জন্যই এই নাম পরিবর্তন। কিন্তু আসল কারণ ছিল—নজরুলের গানের সুর, তাল ও লয়ের মান এতটাই উচ্চমাত্রার ছিল যে, শিল্পীরা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে গানগুলো গাইতে আগ্রহী হয়েছেন। তাঁর গান শুধু সংগীত নয়, বরং একটি আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা হয়ে উঠেছিল।


নজরুলের ইসলামি গান: পারঙ্গমতা ও উত্তরাধিকার

বাংলা সাহিত্য ও সংগীতাঙ্গনে কাজী নজরুল ইসলাম এমন এক অনন্য নাম, যার ইসলামি সংগীত রচনায় পারদর্শিতা এখনো বিস্ময় জাগায়। তাঁর ইসলামি গানের বৈচিত্র্য, সুরের অভিনবত্ব এবং ভাষার কাব্যমাধুর্য বাঙালি মুসলমানের সংগীত সংস্কৃতিকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।


মুসলিম-অমুসলিম শিল্পীদের কণ্ঠে নজরুলের ইসলামি গান

নজরুলের ইসলামি গানের জনপ্রিয়তা এতটাই ব্যাপক যে শুধু মুসলিম শিল্পীরাই নয়, অমুসলিম অনেক শিল্পীও এগুলো নিজ নামেই পরিবেশন করেছেন। ড. অনুপ ঘোষাল, অজয় রায়, আশা ভোঁসলে, মনোময় ভট্টাচার্য, রাঘব চট্টোপাধ্যায়সহ অগণিত শিল্পী নজরুলের ইসলামি গান ধারণ করেছেন। এমনকি উর্দুভাষী অনেক কাওয়ালি শিল্পীও, যাদের গান শুনে একসময় বাঙালিরা ইসলামি সুরের স্বাদ গ্রহণ করতেন, নজরুলের ইসলামি গানের মুগ্ধতায় বাংলা ভাষায় গান রেকর্ড করেছেন। এ থেকে বোঝা যায়, নজরুলের ইসলামি গানের আবেদন কেবল সীমান্ত পেরিয়ে নয়, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে।


নজরুলের ইসলামি গানের দ্রুত রচনা ক্ষমতা

কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন সংগীত রচনায় অতুলনীয় ক্ষিপ্র। এর একটি প্রমাণ পাওয়া যায় আব্বাস উদ্দীন আহমদের একটি ঘটনার মাধ্যমে। তিনি একবার কবির বাসায় গিয়ে অনুরোধ করেছিলেন একটি ইসলামি গজল লেখার জন্য। আব্বাস উদ্দীন নামাজ আদায় করার সময়েই কবি সেই গজল লিখে দেন, যা হলো—

“হে নামাজী, আমার ঘরে নামাজ পড় আজ,

দিলাম তোমার চরণতলে হৃদয় জায়নামাজ।”

এই ঘটনার মাধ্যমে নজরুলের ইসলামি সংগীত রচনায় পারঙ্গমতা যেমন ফুটে ওঠে, তেমনি তাঁর হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত ধর্মপ্রাণ আবেগেরও প্রতিফলন ঘটে।


উত্তরসূরিদের অনুপ্রেরণা

নজরুলের পথ অনুসরণ করে পরবর্তী সময়ে অনেকেই ইসলামি গান রচনায় এগিয়ে আসেন। জসীম উদ্দীন, ফররুখ আহমদ, গোলাম মোস্তফা, মতিউর রহমান মল্লিক প্রমুখ কবি ও সংগীতকাররা নজরুলের প্রভাবেই ইসলামি সংগীতে অবদান রাখেন। তবে মান ও প্রভাবের দিক থেকে কেউই নজরুলকে অতিক্রম করতে পারেননি।

কাজী নজরুল ইসলামের অন্তিম ইচ্ছার বাস্তবায়ন


অন্তিম ইচ্ছার বাস্তবায়ন

১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট কবি নজরুল ইসলাম ইন্তেকাল করেন। তাঁকে কোথায় সমাহিত করা হবে তা নিয়ে আলোচনা চলছিল। অবশেষে তাঁর নিজের একটি ইসলামি গানের কথার প্রতিফলন ঘটানো হয়—

“মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই,

যেন গোর থেকেও মুয়াযযিনের আজান শুনতে পাই।”


তাঁর এই অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী ঢাকার কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

ইসলামি সংগীতে নজরুলের অমরত্ব

নজরুলের আগে মুসলিম সমাজে ইসলামি সংগীত ছিল লোকসংগীতনির্ভর ও কিছুটা সীমাবদ্ধ। কিন্তু তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে ইসলামি গান হয়ে ওঠে সুরেলা, হৃদয়গ্রাহী এবং বৈশ্বিক মানসম্পন্ন। আজও তাঁর ইসলামি সংগীত বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। তিনি প্রমাণ করেছেন, বাংলা ভাষার ইসলামি সংগীতও বিশ্বের যেকোনো প্রথিতযশা ইসলামি সংগীতের সঙ্গে সমান মর্যাদায় দাঁড়াতে পারে।

শেষ কথা

কাজী নজরুল ইসলাম শুধু বিদ্রোহী কবি নন, তিনি ছিলেন বাংলা গানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্রষ্টা। বিশেষ করে ইসলামি গানের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাওহীদ, রিসালাত, নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত থেকে শুরু করে ঈদ, রমজান, মহররম, শবে কদর কিংবা ইসলামি ইতিহাস—প্রায় প্রতিটি বিষয়ে তিনি গানের বাণী রচনা করেছেন। সেই সঙ্গে সুর, ভাষা ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য এনে ইসলামি সংগীতকে দিয়েছেন বিশ্বমানের আসন।

নজরুল ইসলামি গানের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন—সংগীত কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয়; বরং তা হতে পারে ঈমান জাগানোর, আত্মাকে পবিত্র করার এবং সমাজে সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও ন্যায়ের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার শক্তিশালী হাতিয়ার। তাঁর সৃষ্ট ইসলামি গান আজও বাঙালি মুসলমানের অন্তরে অনুপ্রেরণা জাগায়, শ্রোতাদের মনে শান্তি ও ঈমানের শক্তি সঞ্চার করে।

বাংলা সাহিত্য ও সংগীতের ইতিহাসে নজরুলের ইসলামি গান তাই শুধু একটি অধ্যায় নয়, বরং এক অমূল্য ভাণ্ডার। যত দিন বাংলা ভাষা ও মুসলিম সংস্কৃতি বেঁচে থাকবে, তত দিন কাজী নজরুল ইসলামের ইসলামি সংগীত অমর হয়ে থাকবে।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন